সাহিত্য ও সমাজ রচনা

সাহিত্য ও সমাজ রচনা

ভূমিকা

সাহিত্য শব্দটির মূলে আছে ‘সহিত' শব্দটি। পাঠকের সঙ্গে লেখকের, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের যে অন্তরঙ্গতা, সাহিত্য তাকেই রূপ দেয়। যুগ যুগান্তর ধরে সাহিত্যিকেরা তাঁদের রচনাকর্মে একদিকে মানুষের ব্যক্তিমনের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দান করেন, অন্যদিকে প্রকাশ করেন দেশ-কাল-সমাজের একটি বিশেষ চেহারাকে। সাহিত্য সমাজকে বাদ দিয়ে সম্ভব হয় না, এরা পরস্পর জড়িত। তাই সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ।

সাহিত্য ও সামাজিক মানুষ

পূর্বে মনে করা হত কবিরা বাস্তববিমুখ, কল্পনাবিলাসী জীব, সমাজের কোনো কাজেই আসেন না তাঁরা। কিন্তু কথাটি সত্য নয় কারণ তাঁরাও সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতির থেকে নিজেদের সর্বদা বিচ্ছিন্ন রাখতে পারেননি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের রচনায় সমাজের চিত্র বার বার ফুটে উঠেছে। প্রকাশ পেয়েছে সমাজ সম্পর্কে তাঁদের মনোভাব। কালিদাস, শেক্সপিয়র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, টলস্টয়, শরৎচন্দ্র, নজরুল, প্রত্যেকের সাহিত্যে সমাজের বাস্তবচিত্রের যথার্থ রূপ প্রতিফলিত হয়েছে।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য ও সমাজ

প্রাচীনযুগে বাংলা সাহিত্যের এক মাত্র গ্রন্থ চর্যাপদে বৌদ্ধ সহজিয়া মতাবলম্বী ধর্মসাধকরা নিগূঢ় তত্ত্বকথা বলতে গিয়েও আশ্রয় নিয়েছেন বাস্তব জীবনের। সেকালের মানুষের পেশা, নাচ, গান, উৎসব, ব্যাবসা-বাণিজ্যের নানা দিক লক্ষ করা গেছে। অসম বিবাহ ও তার বেদনাময় পরিণতি, সংস্কার, নারীদের সাজসজ্জা প্রভৃতি সমাজের চিত্র ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে পাওয়া যায়। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলিতে রাষ্ট্রনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছায়াপাত ঘটেছে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে সেকালের সমাজের মর্মান্তিক দারিদ্র্য যন্ত্রণার, শঠতা ও নিষ্ঠুর বর্ণভেদ প্রথা ভেসে উঠেছে। তৎকালীন মানুষের বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানের সুন্দর চিত্র চিত্রিত হয়েছে মঙ্গলকাব্যে। সপ্তদশ শতকের মুসলমান সাহিত্য, পরবর্তী শাক্ত সাহিত্য বা বাউলগানেও সমাজের নানা চিত্র পাই।

আধুনিক সমাজ ও সাহিত্য

পলাশির প্রান্তরে আমাদের স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হলেও আমাদের সাহিত্য কিন্তু বিলীন হয়ে যায়নি। বরং সাহিত্যের নবদিগন্ত লক্ষ করা গেছে। গদ্য সাহিত্যের জন্ম ঘটেছে। পদ্য ভাষা থেকে সরে এসে গদ্য ভাষায় নিজের মনের কথা বলতে শুরু করেছেন। আর সেই গদ্য কিন্তু সমাজকে বাদ দিয়ে তৈরি হয়নি। নাটক, উপন্যাস, ছোটোগল্পে মানুষের সামাজিক জীবনচর্যার পরিচয় পাওয়া গেল। উনিশ শতকে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে যে নবজাগৃতির জোয়ার এসেছিল, কুসংস্কারকে পরিত্যাগ করে দেবতাকে দূরে সরিয়ে
মানবতাবাদকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখা দিয়েছিল, তখনকার সাহিত্যে তার নির্ভুল ঠিকানা পাওয়া যায়।

সাহিত্যিকের দৃষ্টিতে সমাজ

‘শিল্পের জন্যই শিল্প’ সাহিত্য ক্ষেত্রে এই মতবাদ এক সময় প্রাধান্য পেয়েছিল। প্রমথ চৌধুরীর মতে সাহিত্য হল ‘বাজে কথার ফুলের চাষ’। নাট্যকার অস্কার ওয়াইল্ড বললেন, “All arts quite useless.” প্রখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ
ঘোষণা করেছিলেন শিল্পের বাস্তবময়তা ও সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনের কথা। সাহিত্যের উদ্দেশ্য সমাজের অন্তর্নিহিত সত্যকে তুলে ধরা, সামাজিক অন্যায়-অসংগতি-দুর্নীতির প্রকৃতরূপ
প্রকাশ করা, এদের কারণসমূহ নির্ণয় করা এবং সমাধানের পথ নির্দেশ করা। তাই সাহিত্যিক হয়ে ওঠেন সমাজ ভাবনার প্রবক্তা, সমাজ গঠনের কারিগর।

উপসংহার

সাহিত্যিক সামাজিক জীব এবং তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যে সমাজের প্রতিফলন। তাই সাহিত্য ও সমাজ পরস্পর সংযুক্ত। সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের যোগ ‘নিবিড়’। সমাজে নানা সমস্যা সংঘাত যত বাড়বে, সাহিত্যও ততই সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যশালী হয়ে উঠবে। কেন না সাহিত্যের বিষয় মানুষের মন ও মনন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url