অরবিন্দ ঘোষ রচনা

অরবিন্দ ঘোষ রচনা

ভূমিকা

“অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহো নমস্কার।
হে বন্ধু, হে দেশবন্ধু, স্বদেশ-আত্মার
বাণীমূর্তি তুমি।”
রবীন্দ্রনাথের এই অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদনেই আমরা শ্রীঅরবিন্দের প্রকৃত রূপটি কিছুটা উপলব্ধি করতে পারি। রত্নপ্রসবিনী বঙ্গজননীর আর এক সন্তান শ্রীঅরবিন্দ। ঊনবিংশ শতাব্দীর স্বর্ণযুগে বাংলার পুণ্যভূমিতে দেওয়ালি উৎসবে আর একটি দীপবর্তিকা জ্বেলেছিলেন যিনি, সেই মহাপুরুষ হলেন শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ।

জন্ম, বংশপরিচয় ও ছাত্রজীবন

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট কলকাতায় অরবিন্দ ঘোষ জন্ম। তাঁর মাতা ছিলেন স্বর্ণলতা দেবী এবং তাঁর পিতা কৃষ্ণধন ছিলেন একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার ভক্ত হওয়ায় অরবিন্দকেও ইংরেজি আদর্শে শিক্ষাদানের জন্য মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পাঠিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ের সেন্ট পলস স্কুলে। মাত্র দু'বছর এই স্কুলে পড়াশুনার পর সাত বছর বয়সে ডঃ ঘোষ তাঁকে নিয়ে সপরিবারে বিলেত যাত্রা করেন। ম্যাঞ্চেস্টারে এক ধর্মযাজক পরিবারে থেকে তাঁর পড়াশুনা চলতে থাকে। অল্পদিনেই তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষিত হয়। গ্রিক, ল্যাটিন, ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় তিনি পারদর্শিতা দেখান। স্কুলের ছাত্র হিসেবে ১৫ বছর বয়সেই প্রথম ইংরেজি কবিতা লেখেন। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেন এবং গুণানুসারে দশম স্থানয়অধিকার করেন। গ্রিক ভাষায় তিনি প্রথম হয়েছিলেন। স্কুলে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বার্ষিক ৮০ পাউন্ড বৃত্তিলাভ করেন এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংস কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ওই কলেজ থেকে ক্লাসিক্যাল ট্রাইপসে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।

কর্মজীবন

বিলেতে থাকাকালে বরোদার মহারাজা গাইকোয়ার সয়াজীরাও- এর সঙ্গে আলাপ হয়। মহারাজা সন্তুষ্ট হয়ে অরবিন্দকে বরোদা কলেজের ইংরেজি অধ্যাপকের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানান। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি বরোদা কলেজে যোগদান করেন। পরে ওই কলেজেরই ভাইস- প্রিন্সিপালের পদ অলংকৃত করেন। এই সময়েই দেশের দুর্দশা তাঁর মনে গভীর বেদনা সৃষ্টি করে এবং তিনি দেশের কাজে আত্মোৎসর্গের সংকল্প করেন।

রাজনৈতিক জীবন

বরোদা কলেজে অধ্যাপনাকালে মহামতি গোখলের সঙ্গে অরবিন্দের পরিচয় ঘটে। এই সময়েই তিনি নাম উল্লেখ না করেই কিছু প্রবন্ধ লেখেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন উপলক্ষে বাংলাদেশে যে নবজাগরণ শুরু হয়েছিল তাতে তিনি আশার আলো দেখতে পান এবং ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বরোদা ত্যাগ করে কলকাতায় এসে ওই আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে দলের প্রচারকার্যে বক্তৃতা করে বেড়ান। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে রাজদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রকারী বলে ধরা পড়েন ও কারাদণ্ড হয়। বিচারের সময় স্বনামধন্য ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাস তাঁকে নিরপরাধ প্রমাণিত করে মুক্তিলাভের পথ করে দেন। এই মামলাই ‘আলিপুরি বোমার মামলা' নামে বিখ্যাত। শ্রীঅরবিন্দকে আলিপুর জেলে রাখা হয়েছিল। এই সময় একাকী থাকার ফলে তিনি ভগবৎচিন্তায় নিমগ্নৎথাকতেন এবং এই জেলেই নাকি তাঁর বাসুদেব দর্শন হয়েছিল।

যোগসাধনা

কারামুক্তির পর শ্রীঅরবিন্দ রাজনীতির জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। অন্তরাত্মার নির্দেশে প্রথমে কলকাতা থেকে চন্দননগর ও পরে পণ্ডিচেরি গমন করেন। সেখানে আশ্রম নির্মাণ করে যোগসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। সুদীর্ঘ ৪০ বছর তিনি পণ্ডিচেরিতে অতিবাহিত করেন। এ জীবন ছিল তাঁর সাধনার জীবন। তিনি ‘আর্য' নামে একটি ইংরেজি দার্শনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সাধনালব্ধ চিন্তাই ছিল এই পত্রিকার প্রধান সম্পদ। ক্রমশ তাঁর গুণমুগ্ধ শিষ্যের সংখ্যা বাড়তে থাকে ও দার্শনিক হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। প্রতিটি মানুষই দেবশক্তির অধিকারী।—এই ছিল তাঁর সাধনালব্ধ বাণী। এই দেবত্বের দিকে অতিমানব হওয়ার দিকে অবিরাম মানুষের যাত্রা। “There is no end to the world's stupendous march.” তিনি এই দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করে বলেছেন, “Our human state cradles the future God.” (সাবিত্রী)।

মৃত্যু ও উপসংহার

সত্যদ্রষ্টা এই মহামানবের জীবনদীপ নির্বাপিত হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর। তাঁর সাধনাস্থল পণ্ডিচেরিতেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। শ্রীঅরবিন্দ ছিলেন ভারতীয় সাধনার মূর্ত প্রতীক। তাঁর জীবনী ও বাণী আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উন্মেষ ঘটাক ও সুপ্ত দেবশক্তি জাগ্রত হোক।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url