স্বদেশী আন্দোলনের ফলাফল

স্বদেশি আন্দোলনের ফলাফল

স্বদেশি আন্দোলন বাংলাতে প্লাবনের মতাে প্রসার লাভ করে। গ্রামেগঞ্জে সভাসমিতি ও বক্তৃতার মাধ্যমে বিলিতি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের প্রয়ােজনীয়তা প্রচার করা হয়। ক্রমশ রাজনীতির সীমাবদ্ধ গণ্ডি ছাড়িয়ে শিল্পজগৎ, শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা শিল্পের জগতেও স্বদেশি আন্দোলন সম্প্রসারিত হয়, যেমন-

[1] স্বদেশি শিল্পের বিকাশ : স্বদেশি আন্দোলনের ফলস্বরূপ দেশের বিভিন্ন স্থানে কুটিরশিল্প এবং দেশীয় পরিচালনায় বড়াে বড়াে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যেমন এই সময়ে : 
i) বাংলায় ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায় বেঙ্গাল কেমিক্যাল কারখানা স্থাপন করেন। 
ii) ডাঃ নীলরতন সরকার জাতীয় সাবান কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
iii) মাদ্রাজে চিদাম্বরম পিল্লাই স্বদেশি জাহাজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। 
iv) স্বদেশি যুগে ভারতে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ হল স্যার জামসেদজি টাটা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামসেদপুরের লৌহ ও ইস্পাত কারখানা।

[2] ছাত্রসমাজের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ : স্বদেশি আন্দোলন ছাত্রসমাজের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায় এই সময়ে তারা বিদেশি কাগজ, কলম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বয়কট করে। এমনকি তারা বিদেশি কাপড়, লবণ, চিনি, মদ প্রভৃতি দোকানের সামনে পিকেটিং করে। ছাত্রদের দমন করার জন্য সরকার কানাইল সার্কুলার জারি করতে বাধ্য হয়।
[3] জাতীয় শিক্ষার বিস্তার : স্বদেশি আন্দোলনের যুগে বহিষ্কৃত ছাত্রদের শিক্ষালাভের জন্য জাতীয় শিক্ষার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় এবং এই উদ্দেশ্যে 'জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ প্রতিষ্ঠিত হয় (মার্চ 1906)। এই যুগে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের নেতৃত্বে জাতীয় মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন স্থানে 24টি মাধ্যমিক ও 300টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। জাতীয় শিক্ষার আদর্শ বাংলার বাইরেও জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

[4] সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবধারা : স্বদেশি আন্দোলনের যুগে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য, সংগীত ও নাটক রচনার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের আদর্শ প্রচারিত হয়। এদের মধ্যে কবিগুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন ও রজনীকান্তের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। স্বদেশি শিল্পকর্মে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসু অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন।

[5] জাতীয়তাবাদী ঐক্য ও সংহতির বিস্তার : বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলনের মাধ্যমেই জাতি সর্বপ্রথম উপলদ্ধি করে যে, ব্রিটিশ এবং ভারতবাসীদের স্বার্থ পরস্পর বিরােধী। ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে ভারতীয়দের যে মােহ ছিল, বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলনের ফলে তা কেটে যায়। সুতরাং বলা যায় যে, স্বদেশি আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ঐক্য ও সংহতি স্থাপন করতে সাহায্য করে।

[6] রাজনৈতিক ফলাফল : রাজনীতির ক্ষেত্রেও স্বদেশি আন্দোলনের সাংঘাতিক প্রভাব ছিল, যেমন :-
i) স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাবে কংগ্রেসে চরমপন্থী রাজনীতি প্রাধান্য লাভ করে এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস চরমপন্থী ও নরমপন্থী এই দুটি গােষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়।
ii)ব্রিটিশের দমননীতির চাপে বঙ্গভঙ্গ বিরােধী নিস্ক্রিয় প্রতিরােধ আন্দোলনে ব্যর্থ হলে বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দেয় এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র বিপ্লবের সূচনা হয়।
iii) স্বদেশি আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রথম ব্যাপক গণআন্দোলনের সূচনা করে। এমনকি এই আন্দোলন গান্ধিজির নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনা করে।
[7] সরকারের ওপর প্রভাব : স্বদেশি আন্দোলনের সময় প্রবল গণবিক্ষোভ ও বিপ্লবী কার্যকলাপে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে 1911 খ্রিস্টাব্দের 12ই ডিসেম্বর সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হন, কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়, এর ফলে কলকাতার গুরুত্ব অনেক কমে যায়।

উপরে বর্ণনা থেকে যেসব ছোট প্রশ্ন হতে পারে-
1. বেঙ্গাল কেমিক্যাল কারখানা কে স্থাপন করেন?
উঃ ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
2. জাতীয় শিক্ষা পরিষদ কত খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উঃ 1906 খ্রিস্টাব্দে।
3. জাতীয় সাবান কারখানা কে প্রতিষ্ঠা করেন?
উঃ ডাঃ নীলরতন সরকার।
4. জামসেদপুরের লৌহ ও ইস্পাত কারখানা কে প্রতিষ্ঠা করেন?
উঃ স্যার জামসেদজি টাটা।
5. কত খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়?
উঃ 1911 খ্রিস্টাব্দের 12ই ডিসেম্বর।
6. কত খ্রিস্টাব্দে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়?
উঃ 1911 খ্রিস্টাব্দে।

আরো পড়ুন-
2. মহাবিদ্রোহের কারণ
3. মোগল সাম্রাজ্যের ব্যর্থতার কারণগুলি কি কি?
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url