খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পূর্ব ভারতের প্রতিবাদী আন্দোলনের কারণগুলি আলোচনা করো।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পূর্ব ভারতের প্রতিবাদী আন্দোলনের কারণ
ভূমিকা
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক ছিল ধর্মীয় আন্দোলনের যুগ। সহজ-সরল ধর্মীয় ব্যবস্থা ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠে। উক্ত জটিল ধর্মীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা প্রতিবাদী আন্দোলন নামে পরিচিত। তবে এর পিছনে অনেক কারণ ছিল যথা-(i) ধর্মীয় কারণ
কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মচিন্তায় প্রথম নবজাগরণ ঘটায় শ্রমণ ও পরিব্রাজক নামে সাধু-সন্ন্যাসীরা। এ. এল. ব্যাসাম মন্তব্য করেছেন যে, “The age in which true history appears in India was one of great intellectual and spiritual ferment." ‘দ্বিজ’ হিসাবে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের বেদ পাঠ করার অধিকার থাকলেও অন্যদের ছিল না। অতিরিক্ত যাগযজ্ঞ ও বলিদান (500-600 গোরু বলি দেওয়া হয়) মানুষের মনে বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করে। বিকৃতিপূর্ণ ধর্মীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। উক্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৌদ্ধ, জৈন এবং আজীবিক সম্প্রদায়ের মতো ৬৩টি ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রতিবাদে সোচ্চার হয়।
(ii) অর্থনৈতিক কারণ
কৃষি ও বাণিজ্যে নবোদিত গৃহপতি ও শ্রেষ্ঠীশ্রেণি ঐশ্বর্যশালী হয়ে সমাজ উচ্চস্থান চেয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজে তারা নীচু জাতি বলে বিবেচিত হত। ব্যাবসাবাণিজ্যের জন্য বণিকরা সমুদ্র পাড়ি দিত যা বৈদিক ধর্মে নিষিদ্ধ ছিল। এটা মেনে চলা বণিকদের পক্ষে আপত্তিকর ছিল। বৈদিক যুগে সুদের ব্যাবসাকে পাপ বলে মনেৎকরা হত কিন্তু মহাজন বা শ্রেষ্ঠীশ্রেণি সুদ কারবারে ধনশালী হয়েছিল। একটি বড়ো যজ্ঞে প্রায় 500-600 টি গোহত্যা করা হত। সাধারণ কৃষকরা এতে ক্ষুব্ধ ছিল।
(iii) সামাজিক কারণ
সমাজে বর্ণ প্রথার কঠোরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে। সম্পদশালী বৈশ্যরা নিয়মিত কর প্রদান করলেও তারা সামাজিক মর্যাদার স্বীকৃতি পেত না। শেষ পর্যন্ত শুরু হয় ব্রাহ্মণ-বৈশ্য দ্বন্দ্ব। শূদ্ররা সামাজিক বঞ্চনার শিকার হয়। এই পরিস্থিতি আন্দোলনের বাতাবরণ গড়ে তোলে।
(iv) ভাষাগত কারণ
দুর্বোধ্য সংস্কৃত ভাষা সকলের কাছে বোধগম্য ছিল না। তাই প্রাকৃত ভাষাকে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে। তা ছাড়া পালি ভাষা ছিল অন্যতম। সংস্কৃত ভাষা অপেক্ষা উক্ত ভাষাগুলি সহজ সরল ছিল। জোর করে সংস্কৃত ভাষা সকলের ওপর চাপিয়ে দিলে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
(v) দার্শনিক প্রভাব
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে একদল যুক্তিবাদী দার্শনিক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। তারা বৈদিকযুগের যাগযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রচার করতে থাকে। তারা বলেন কর্মের ওপর মানুষের জীবন বাঁধা। দুঃখ কষ্ট থেকে যাগযজ্ঞ কখনোই মুক্তি দিতে পারে না। বৌদ্ধ জৈন প্রমুখ দার্শনিকদের প্রচার বৈদিক ব্রাহ্মণ প্রাধান্যকে নষ্ট করে। তাই বলা যায় যে বিভিন্ন কারণের মিলিত প্রভাবেই প্রতিবাদী আন্দোলনের পটভূমি তৈরির ক্ষেত্র গড়ে তোলে।