লর্ড ডালহৌসি ও লর্ড ওয়েলেসলির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি

লর্ড ডালহৌসির ও লর্ড ওয়েলেসলির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি বর্ণনা করো।

লর্ড ডালহৌসির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি

ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসে লর্ড ডালহৌসির নাম উল্লেখযোগ্য। লর্ড ডালহৌসি ১৮৪৮-৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। তাঁর সাম্রাজ্যবিস্তারের তিনটি প্রধান নীতি ছিল—
(১) সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে রাজ্যজয়, 
(২) স্বত্ববিলােপ নীতি প্রয়ােগের মাধ্যমে রাজ্যজয়, 
(৩)কুশাসন ও অন্যান্য অজুহাতে রাজ্যজয়।

(১) যুদ্ধদ্বারা রাজ্য জয় : ডালহৌসি সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে দুটি রাজ্য জয় করেন। (১) ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন শিখ রাজ্যের অবসান ঘটান । (২) ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ইঙ্গ- ব্রহ্মযুদ্ধের মাধ্যমে ব্রহ্মদেশের পেগু নামক স্থানটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

(২) স্বত্ববিলােপ নীতি : ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে লর্ড ডালহৌসির প্রধান নীতি স্বত্ববিলােপ নীতির প্রয়ােগ। এই নীতির মূল কথা ছিল- ব্রিটিশের প্রশ্রয়ে ও অনুগ্রহে স্থাপিত কোনাে দেশীয় রাজার অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যু হলে সেই রাজ্যটি সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হবে। কোম্পানির বিশেষ অনুমােদন ব্যতীত ওই রাজ্যে দত্তক পুত্রের উত্তরাধিকার থাকবে। এই নীতি প্রয়ােগের মাধ্যমে ডালহৌসি সাতারা, নাগপুর, ঝাসি, সম্বলপুর প্রভৃতি রাজ্য দখল করেন। কণাটকের নবাব ও তাঞ্জোরের রাজার উপাধি ও বাৎসরিক বৃত্তি থেকে তাদের উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত করা হয়। বৃত্তিভােগী পদচ্যুত পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাও-এর মৃত্যুর পর তার দত্তক পুত্র নানাসাহেবকে বৃত্তি থেকে বঞ্চিত করেন।

(৩) কুশাসন ও অন্যান্য অজুহাতে রাজ্যজয় : লর্ড ডালহৌসি কুশাসনের অজুহাতে অযােধ্যার নবাবকে বৃত্তিভােগীতে পরিণত করে অযােধ্যা রাজ্যটি দখল করে নেন। আবার অন্যান্য অভিযােগে বেরার প্রদেশটি ও সিকিম রাজ্যের কিছু অংশ তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

এইভাবে লর্ড ডালহৌসি সাম্রাজ্যবাদ প্রয়ােগ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান।

লর্ড ওয়েলেসলির সাম্রাজ্যবিস্তার নীতি

ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসে লর্ড ওয়েলেসলির নাম উল্লেখযােগ্য। সাম্রাজ্যবাদী শাসক হিসাবে লর্ড ওয়েলেসলি ভারতীয় ইতিহাসে সু-পরিচিত। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তিনটি নীতির আশ্রয় নেন। 
(১) মহীশূর ও মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ, 
(২) সুরাট, তাঞ্জোর ও কণাটিক নামক তিনটি রাজ্যে প্রভাব খাটিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, 
(৩) অধীনতামূলক মিত্ৰতা নীতির প্রয়ােগ।

(১) মহীশূর ও মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ : ওয়েলেসলি মহীশূরের শাসক টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে টিপু পরাজিত ও নিহত হলে স্বাধীন রাজ্যের পতন ঘটে। মারাঠাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযােগে ওয়েলেসলি মারাঠা রাজ্যে হস্তক্ষেপ করেন এবং এই সময় তিনি মারাঠা পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাওকে বেসিনের চুক্তি (১৮০২) অনুযায়ী অধীনতামূলক মিত্ৰতানীতিতে আবদ্ধ করেন। মারাঠা রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করা সত্ত্বেও হােলকারের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে পদত্যাগ করেন।

(২) সুরাট, তাঞ্জোর ও কর্ণাটক দখল : ওয়েলেসলি নানা অজুহাতে বিনা যুদ্ধে সুরাট, তারে ও কর্ণাটক কোম্পানির শাসনাধীনে আনেন। সুরাটের নবাব অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে নবাবের ভাইকে বৃত্তি দিয়ে তিনি সুরাট দখল করেন। তাঞ্জোর রাজ্যের উত্তরাধিকার বিবাদের সুযােগে সেখানকার শাসককে বৃত্তি দিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। কর্ণাটকের সঙ্গে টিপুর যােগাযােগের অজুহাতে তিনি কর্ণাটক রাজ্যটিও দখল করেন।

(৩) অধীনতামূলক মিত্ৰতা নীতির প্রয়ােগ: তবে এদেশে সাম্রাজ্যবিস্তারে ওয়েলেসলির প্রধান অস্ত্র ছিল অধীনতামূলক মিত্ৰতা নীতির প্রয়ােগ। এই অধীনতামূলক মিত্ৰতা নীতির শর্তগুলি ছিল—
(১) ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ রাজ্যটি কোম্পানির অনুমতি ব্যতীত তৃতীয় কোনাে শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ ঘােষণা করতে পারবে না, এমনকি সন্ধি স্থাপন করতে পারবে না।
(২) ওই রাজার রাজধানীতে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি থাকবেন যার নির্দেশে রাজা মেনে চলবেন।
(৩) ইংরেজ ব্যতীত অন্য কোনাে ইউরােপীয়কে ওই রাজ্যে থাকার অনুমতি দেওয়া হবে না।
(৪) ওই দেশীয় রাজা নিজ খরচে একদল ব্রিটিশ সৈন্য পােষণ করবেন নতুবা সৈন্যদের খরচ চালানাের জন্য কোম্পানিকে রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দেবেন।

এই সব শর্তের বিনিময়ে ইংরেজরা দেশীয় রাজাকে শত্রুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করবে। এই নীতি প্রয়ােগ করে তিনি হায়দরাবাদ, অযােধ্যা, মারাঠা রাজ্যের কিছু অংশ জয় করেন।
এইভাবেই বিভিন্ন নীতি প্রয়ােগ করে লর্ড ওয়েলেসলি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিলেন।

উপরের থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর

1. স্বত্ববিলোপ নীতি কি?
উঃ ব্রিটিশের প্রশ্রয়ে ও অনুগ্রহে স্থাপিত কোনাে দেশীয় রাজার অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যু হলে সেই রাজ্যটি সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হবে। কোম্পানির বিশেষ অনুমােদন ব্যতীত ওই রাজ্যে দত্তক পুত্রের উত্তরাধিকার থাকবে।
2. স্বত্ববিলোপ নীতি কে প্রবর্তন করেন?
উঃ লর্ড ডালহৌসি।
3. অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির শর্তগুলি কি কি?
উঃ অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির শর্তগুলি হল- (১) ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ রাজ্যটি কোম্পানির অনুমতি ব্যতীত তৃতীয় কোনাে শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ ঘােষণা করতে পারবে না,এমনকি সন্ধি স্থাপন করতে পারবে না।
(২) ওই রাজার রাজধানীতে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি থাকবেন যার নির্দেশে রাজা মেনে চলবেন।
(৩) ইংরেজ ব্যতীত অন্য কোনাে ইউরােপীয়কে ওই রাজ্যে থাকার অনুমতি দেওয়া হবে না।
(৪) ওই দেশীয় রাজা নিজ খরচে একদল ব্রিটিশ সৈন্য পােষণ করবেন নতুবা সৈন্যদের খরচ চালানাের জন্য কোম্পানিকে রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দেবেন।
4. অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির প্রবর্তক কে?
উঃ লর্ড ওয়েলেসলি।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url