মধ্যযুগ বলতে কী বুঝ? ভারতে মধ্যযুগ কখন দেখা দিয়েছিল?

মধ্যযুগ

মধ্যযুগ কাকে বলে?
উঃ এককথায়, পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালকে বলে মধ্যযুগ।
মধ্যযুগ বলতে কী বুঝ?
উত্তরঃ প্রাচীন যুগে গড়ে ওঠা রােম সাম্রাজ্য ছিল আয়তনে বিশাল। এই বিশাল রােম সাম্রাজ্য ক্রমে দু’ অংশে ভাগ হয়ে যায়। সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশের রাজধানী হয় রােম। আর পূর্ব অংশের রাজধানী হয় কৃষ্ণসাগরের তীরে অবস্থিত কনস্ট্যান্টিনােপল। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রােমনগরী বর্বর জাতি অধিকার করলে ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় অর্থাৎ প্রাচীন যুগের অবসান ঘটে। আর ১৪৫৩
খ্রিস্টাব্দে তুরকি আক্রমণে পূর্ব রােম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনােপলের পতন, ঘটলে শেষ হয় ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায় অর্থাৎ মধ্যযুগের। সুতরাং রােমের পতনের পর থেকে কনস্ট্যান্টিনােপলের পতন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর সময়কালকে ঐতিহাসিকেরা মধ্যযুগ বলে বর্ণনা করেছেন।

ভারতে মধ্যযুগ কখন দেখা দিয়েছিল?
উত্তরঃ খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মধ্য এশিয়ার তুন নামে এক দুর্ধর্ষ জাতি ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। ভারতবর্ষে তখন গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসন শিথিল হয়ে পড়েছিল। পশ্চিম ইউরােপে প্রায় একই সময়ে চলেছিল জার্মান গােষ্ঠীগুলির আক্রমণ। জার্মানদের আক্রমণে রােমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছিল কিন্তু হুন আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙে যায়নি, দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষে গুপ্তরাজ বুধগুপ্তের রাজত্বকালের সময় পর্যন্ত সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব কোনােক্রমে রক্ষা পেয়েছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙে যাবার আগে থেকেই ভারতবর্ষের সমাজ ও আর্থিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন দেখা দেয়। ইউরােপের মতাে ভারতবর্ষের আর্থিক ব্যবস্থা দাসমজুরদের ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি, তবে ক্রীতদাস প্রথা ছিল। গুপ্তযুগের শেষে ক্রীতদাস প্রথা অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু দাস প্রথার একেবারে অবসান ঘটল না। ধনী শ্রেণি, সদাগর সমাজে ক্রীতদাস প্রথা বহাল রইল। কৃষির ক্ষেত্রে স্বাধীন চাষি জমিতে চাষ-আবাদ করার এবং উৎপন্ন ফসল ভােগ করার অধিকার পেল। জমির মালিক হলেন সামন্ত রাজা। সামন্ত রাজারা যেমন ছিলেন জমি ও রাজস্বের অধিকারী, তেমনি চাষি ও তার পরিবার পরিজনেরও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। চাষির জীবন ছিল জমির সঙ্গে বাধা। এই নতুন আর্থিক ব্যবস্থাকে বলা হয় সামন্ততন্ত্র। মধ্যযুগে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সামন্ততন্ত্র। গুপ্তযুগের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতবর্ষে এই রূপান্তর দেখা দিলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে ভারতবর্ষে মধ্যযুগের প্রাথমিক সূচনা বলে ধরা হয়। ইউরােপের মতাে ভারতবর্ষেও মধ্যযুগের সময়সীমা মােটামুটি খ্রিস্টীয় পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত ধরা হয়।

ইউরোপের মধ্যযুগ বলতে কী বোঝো?
উঃ মধ্যযুগের সূচনায় প্রাচীন সাম্রাজ্যগুলির বিলােপ শুরু হয়। ইউরােপে বর্বর জার্মান উপজাতিরা রােমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করতে থাকে। তারা শেষ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরােপে রােমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। তারপর থেকে ইউরােপে মধ্যযুগ আরম্ভ হয়।

ইউরোপে মধ্যযুগের সূচনা কীভাবে ঘটে ব্যাখ্যা করো।
প্রাচীন ইউরোপের যে সমাজ ও সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার ভিত্তি ছিল দাসমজুর। রোমান সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে দাস সমাজ ব্যবস্থার পরিপূর্ণতা ঘটে। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক থেকে ইউরোপে দাস সমাজের ভাঙন দেখা দেয়। দাস মালিকদের অত্যাচার, দাস বিদ্রোহ এবং বহিরাগত জাতিগোষ্ঠীর আক্রমণের ফলে রোমান দাস মালিক বা অভিজাতদের শাসন ভেঙে পড়তে থাকে। বিশাল রোমান সাম্রাজ্য ভেঙে যায়। দুটি সাম্রাজ্যের উৎপত্তি হয়। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী হয় রোম। বাইজানটিয়াম (কনস্ট্যান্টিনোপল) হয় পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অল্পকালের মধ্যে পতন ঘটে। রোমান সম্রাট অগস্টাস সীজার-এর পরবর্তী শাসকরা ছিলেন অযোগ্য ও অত্যাচারী। পশ্চিম রোমের দাস ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। রোমের অভিজাত সম্প্রদায় ও সেনাপতিদের মধ্যে বিরোধ সেখানে অরাজকতা সৃষ্টি করে। দেশে ক্রমাগত দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও প্রজাবিদ্রোহ ঘটতে থাকে।

মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
রোমের পতন থেকে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন পর্যন্ত এক হাজার বছর সময়কে ইতিহাসের মধ্যযুগ বলে। প্রাচীন যুগে যেমন বড়ো রাজ্য গড়ে উঠেছিল মধ্যযুগে তেমন আর বিশাল সাম্রাজ্য দেখা যায়নি। তার পরিবর্তে সর্বত্র ছোটো ছোটো রাজ্য গড়ে উঠতে থাকে। রাজ্যের রাজারা দুর্বল হয়ে পড়ায়, সামন্ত অর্থাৎ ভূস্বামী বা জমির মালিকরা সর্বেসর্বা হয়ে উঠল। বর্বর আক্রমণ, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, শিক্ষা-দীক্ষার অভাব, ব্যাবসাবাণিজ্য ও সভ্যতা-সংস্কৃতির অবনতি মধ্যযুগে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই সবই হল মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য।

ইউরোপ ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে মধ্যযুগ কী সমসাময়িক ছিল?
ইউরোপের মধ্যযুগের শুরু এবং ভারতবর্ষে মধ্যযুগের শুরু প্রায় একই সময় ঘটেছিল—একথা ঠিক নয়। ইউরোপে জার্মান আক্রমণে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে মধ্যযুগের শুরু বলে ধরা হয়। মোটামুটিভাবে প্রায় সেই সময়েই ভারতবর্ষে মূল গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়েছিল। ইউরোপে হুনদের আক্রমণে সমাজে যেমন বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, জার্মানরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে রোমে প্রবেশ করে সমগ্র শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে অচল করে দিয়েছিল; তেমনি ভারতবর্ষেও প্রায় একই চিত্র সে সময় দেখা যায়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের ওপর আক্রমণ করে হুনরা তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারলাভ করতে চেয়েছিল। সে সময় সামন্ত রাজারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীন রাজত্ব শুরু করেন। ফলে, কেন্দ্রীয় শাসন- ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হলেও সেই সময়কে ভারতবর্ষের ইতিহাসে মধ্যযুগের শুরু বলা যায় না। ভারতবর্ষে মধ্যযুগের সূচনা মুসলমান শাসন শুরু হওয়ার সময় থেকে ধরা হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর সর্বভারতীয় রাজতন্ত্রের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে পড়ে এবং আঞ্চলিক রাজতন্ত্র গড়ে ওঠে। সপ্তম শতাব্দীতে হর্ষবর্ধনের পর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য ভেঙে পড়ে এবং সামন্ত রাজারা প্রবল হয়ে ওঠেন। দ্বাদশ শতক থেকে ভারতে তুরকি আক্রমণ প্রবল হয়ে ওঠে। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের রাজারা জোটবদ্ধ হতে পারেন না। ফলে তুরকি আক্রমণকারীরা ভারত জয় করে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত করে। তুরকি সুলতানেরা ইক্তা ও জায়গীর প্রথা প্রচলন করার ফলে সামন্তব্যবস্থা কায়েম হয়। এই সময় থেকে (৫৫০ খ্রিঃ) ভারতের মধ্যযুগ আরম্ভ হয় বলে মনে করা হয়।

প্রাচীন যুগের অবসানের পর মধ্যযুগের শিক্ষা ব্যবস্থায় খ্রিস্টান চার্চগুলির ভূমিকা কী ছিল?
পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে খ্রিস্টান চার্চের ক্ষমতা লুপ্ত হয়নি। বরং চার্চের ক্ষমতা বেড়েই গিয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে চার্চগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। চার্চের প্রভাব সবচেয়ে পড়েছিল শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। জনসাধারণের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা। ধর্ম-শিক্ষার ওপর তাঁরা সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ধর্মযাজকরা গির্জা বা মঠে প্রাচীন পণ্ডিতদের লেখা পুঁথি নকল করতেন এবং ওই বিষয়েই শিক্ষা দিতেন। ধীরে ধীরে বড়ো বড়ো গীর্জাগুলি উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হল। শেষ দিকে ইউরোপের নানা জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ইতালির বেলোনা এবং সলেরনো এবং ফ্রান্সে বিশ্ববিদ্যালয়, ইংলন্ডে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষাকেন্দ্র বিদ্যাচর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল। ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে গুটেনবার্গ উন্নত মুদ্রাযন্ত্রের প্রবর্তন করেন ফলে শিক্ষার আরও দ্রুত প্রসার ঘটে। শিক্ষার প্রসারের ফলে মানুষ গতানুগতিক জীবনযাত্রার পরিবর্তন জানতে আগ্রহী হয়। ল্যাটিন ভাষা ও ধর্মতত্ত্ব রোমান ও জার্মানদের শিক্ষার বিষয় হল। ইউরোপের ইতিহাসে যে রূপান্তরের কথা বলা হল তা কেবলমাত্র ইউরোপেই দেখা দিয়েছিল তা নয়। পৃথিবীর সব দেশেই এই রূপান্তরের কাজ চলেছিল।

গুপ্তযুগে সামন্তপ্রথা কীভাবে গড়ে ওঠে?
গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার আগে থেকে ভারতবর্ষের সমাজ ও আর্থিক ব্যবস্থার পরিবর্তন দেখা দেয়। ইউরোপের মতো ভারতবর্ষে আর্থিক ব্যবস্থা মজুরদের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তবে ক্রীতদাস প্রথা ছিল। গুপ্তযুগের শেষে ক্রীতদাস প্রথা ভেঙে গেল কিন্তু দাস প্রথার সম্পূর্ণ অবসান হল না। জমির মালিক হলেন সামন্ত রাজারা। সামন্ত রাজারা যেমন ছিলেন জমি ও রাজস্বের অধিকারী, তেমনি চাষি ও তার পরিবার পরিজনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url