ভক্তিবাদ বলতে কি বোঝায় ? কয়েকজন ভক্তিবাদ প্রচারকদের নাম করো এবং প্রচারকদের সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভক্তিবাদ বলতে কি বোঝায় ? কয়েকজন ভক্তিবাদ প্রচারকদের নাম করো এবং প্রচারকদের সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তরঃ সুলতানি যুগে হিন্দু ও মুসলমান বহুদিন এক্সঙ্গে পাশাপাশি বাস করার ফলে একের প্রভাব অন্যের ওপর পড়েছিল। পরস্পরের ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছিল। ইসলামধর্মের প্রভাবে হিন্দু সমাজে রক্ষণশীলতা বেড়েছিল। আবার ইসলামধর্মে যেমন আল্লাহকেই একমাত্র ঈশ্বর বলে মনে করা হয়, হিন্দুধর্মে সেই আদর্শকে অনুসরণ করে উদার ভক্তিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। সমস্ত ধর্মই সমান, ঈশ্বর বা ভগবান এক এবং অভিন্ন, ভক্তি বা ভালােবাসাই ঈশ্বর লাভের একমাত্র উপায়—এই হল ভক্তিবাদের মূলকথা। এই আদর্শকেই অনুসরণ করে হিন্দুধর্মের ভক্তিবাদের সাধকরা শ্রীকৃষ্ণ বা রামের প্রতি ভক্তিকেই মুক্তির পথ বলে প্রচার করেছিলেন।
ভক্তিবাদের প্রচারক
দক্ষিণ ভারতে রামানুজ প্রথম রামের প্রতি ভক্তির কথা প্রচার করেন। এছাড়া রামানুজের শিষ্য রামানন্দ, বল্পভাচার্য, শ্রীচৈতন্যদেব, কবীর ও নানক ছিলেন ভক্তিবাদের প্রচারক।
শ্রীচৈতন্যদেব
হিন্দুদের মধ্যে শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন ভক্তিবাদের প্রধান প্রচারক। নবদ্বীপের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে 1486 খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম হয়। শিশুকাল থেকেই তিনি ছিলেন বিদ্যানুরাগী এবং সে সময় থেকেই ধর্মের প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ও দর্শনে পাণ্ডিত্য লাভ করে তিনি উপলব্ধি করেন—একনিষ্ঠ প্রেমই ঈশ্বর লাভের প্রধান উপায়। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে তিনি সংসার ত্যাগ করেন। যাগযজ্ঞ বা মূর্তি পূজায় তার আস্থা ছিল না। ভারতের বিভিন্ন দেশ ঘুরে তিনি শ্রীকৃয়ের নামগান প্রচার করেন। তারপর বাকি জীবন পুরীতে কাটান। শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ ভগবানের প্রতি গভীর প্রেম ও ভক্তির মধ্য দিয়েই মানুষ সংসারের মায়া ছিন্ন
করে ভগবানের আশীষ লাভ করতে পারে। এই ছিল শ্রীচৈতন্যের ধর্ম প্রচারের মূলকথা। তিনি যে ধর্ম প্রচার করেন, তা বৈষ্ণবধর্ম নামে পরিচিত। তিনি জাতিভেদ মানতেন না। হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ তার কাছে ছিল না। তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন সব জাতির লােক। যবন হরিদাস নামে এক মুসলমান শিষ্য ছিল তার। হিন্দুরা শ্রীচৈতন্যকে শ্রীকৃষ্ণের অবতার বলে মনে করেন।
কবীর
কবীরের জন্ম হয়েছিল মুসলমান তাঁতির পরিবারে। তিনি হিন্দু বা মুসলমান কোনাে ধর্মের আচার অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বলতেন—ঈশ্বর বিশ্বাস, মনের পবিত্রতা ও মানুষে মানুষে সমতা ইত্যাদি—মন্দির ও মসজিদে পুজো পর্বের অনুষ্ঠানের চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ। তিনি বলতেন যে, সব ধর্মই এক, ঈশ্বর ও আল্লাহর মধ্যে কোনাে প্রভেদ নেই। কবীরের শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই লােক ছিল।
নানক
নানক ছিলেন ভক্তিবাদের অপর এক প্রচারক লাহােরের তালবন্দী গ্রামের এক ব্যবসায়ীর ঘরে তার জন্ম হয়। বাল্যকাল থেকে তার ধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল। ব্যবসায়ের কাজে তিনি কিছুদিন সময় কাটিয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মের প্রতি আকর্ষণ তার বাড়তে থাকার ফলে তিনি ব্যাবসায়ের টাকা-পয়সা সবই গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে থাকেন। এরপর ধর্মের দিকেই পুরােপুরি মনােনিবেশ করলেন। জাতিভেদ প্রথা তিনিও মানতেন না। তিনি তীর্থে গিয়েছিলেন। মক্কা ও বােগদাদেও তিনি গিয়েছিলেন। সমস্ত ধর্মের মধ্যে সমন্বয়। ঘটানাে ছিল তার উদ্দেশ্য। তার প্রচারিত ধর্মের নাম ‘শিখ’ ধর্ম। শিখ শব্দের অর্থ হল শিষ্য। তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে পারত যে কোনাে জাতের লােক। ঈশ্বর এক এবং তার রাজত্বে সকলের সমান অধিকার আছে, ভালােবাসার মধ্য দিয়েই ঈশ্বরকে লাভ করা যায়—এ সবেই তার বিশ্বাস ছিল এবং এই মতই তিনি প্রচার করেছিলেন। তবে এ সবের জন্য গুরু নানক প্রত্যেকের উচিত নিজের মনকে শুদ্ধ রাখা। 'গ্রন্থসাহেব’ নামক শিখ ধর্মগ্রন্থে তার মতবাদ পাওয়া যায়। শিখরা এই গ্রন্থটিকে অতি পবিত্র বলে মনে করেন।
আরো পড়ুন-