ভারতের জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ

ভারতের সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ

ভূমিকা

জাতীয়তাবাদ হল একটি ভাবগত ধারণা। ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি যে-কোনও একটি কারণে যখন একটি দেশের আপামর জনসমাজের মধ্যে গভীর একাত্ববোধ জন্মায় এবং এই জনসমাজের প্রত্যেক অংশ যখন একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী বলে মনে করে, তখন তা জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটতে থাকে। আমেরিকার উপনিবেশগুলির স্বাধীনতাপ্রাপ্তি, আয়ারল্যান্ডের হোমরুল আন্দোলন, ইটালির জাতীয়তাবাদ, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় চেতনার অভিঘাত ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করতে সাহায্য করেছিল। তবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রধান উৎস ছিল ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি ও তার বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব। এর পাশাপাশি ছিল সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের নানা উদ্যোগ। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদ উন্মেষের কারণগুলি হল-

(১) পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব

পাশ্চাত্য ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষিত ভারতীয়দের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ইউরোপীয় সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, অর্থনীতি, মানবতাবাদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করেছিল। আর তাঁদের বোধ ও মননশীলতার ছায়া পড়েছিল সাধারণ মানুষের মধ্যেও।

(২) জাতিগত বিভেদ

ব্রিটিশ শাসক ও কর্মচারীদের মনে জাতিগত অহমিকা বা আত্মম্ভরিতা এতটাই ছিল যে তাদের আচরণে তা প্রকাশ পেত। রামমোহন ও বঙ্কিমচন্দ্রকে ব্রিটিশ সাহেবের সামনে পালকি চড়ার ‘অপরাধে’ অপমানিত হতে হয়। কলকাতা মিউজিয়ামে বিদ্যাসাগরকে চটি পরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সাধারণ মানুষকে আরও বেশি নাজেহার হতে হয়। রেলের কামরা বা প্রতীক্ষালয়, ক্লাব, হোটেল, রঙ্গালয়, সরকারি উচ্চপদ প্রভৃতিতে ব্রিটিশদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকত। প্রাত্যহিক জীবনে নানাভাবে ঘৃণা বা অশালীন আচরণের শিকার হতে হত ভারতীয়দের। এসবও জাতীয়তাবাদ উন্মেষের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

(৩) সরকারি দমননীতি

ভারতীয়দের সাধারণ জীবনযাপনের উপর ব্রিটিশ
সরকার নানাভাবে আইনি বাধানিষেধ আরোপ করত। অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি, স্বত্ববিলোপ নীতি, ভারতশাসন আইন, মিউনিসিপ্যালিটি আইন, সংবাদপত্র আইন, নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন প্রভৃতির মাধ্যমে নানা স্তরের ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি ভারতবাসীর মধ্যে তীব্র বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।

(৪) অর্থনৈতিক শোষণ

ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের পর সে দেশের উৎপাদিত পণ্য এ দেশের বাজার প্রায় করায়ত্ত করে ফেলেছিল। ভারতীয় মাঝারি ও কুটিরশিল্প ক্রমশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে পড়েছিল। এর উপর ছিল অত্যধিক কৃষি কর বা নানা আর্থিক কর আরোপ, যা সাধারণের জীবনে চরম হতাশার সৃষ্টি করে। এরই সঙ্গে ছিল ব্রিটিশ স্নেহধন্য জমিদার, মজুতদার, মহাজনদের আর্থিক শোষণ। ফলে ক্রমশ ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাবের উষ্ণ হাওয়া বইতে লাগল ভারতবাসীর মধ্যে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url