ছাত্র জীবনে সমাজসেবা রচনা

ছাত্রজীবনে সমাজসেবা রচনা

“আমরা শক্তি আমরা বল আমরা ছাত্রদল।”

ভূমিকা

একটি দেশের আশা-ভরসার স্থল, একটি জাতির মেরুদণ্ড হল ছাত্রসমাজ। তারা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। মানব জীবনের প্রস্তুতির সর্বশ্রেষ্ঠ সময় হল ছাত্রজীবন। আগে বলা হত—“ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ” অর্থাৎ অধ্যয়নই ছাত্রজীবনের একমাত্র তপস্যা। কিন্তু বর্তমান যুগে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। আজকের ছাত্র ভবিষ্যতের দেশ নায়ক হতে পারে। একজন ছাত্রের চরিত্রগঠন ও শরীর গঠনের জন্য যেমন লেখাপড়া ও খেলাধুলা প্রয়োজন তেমনি আবার তার দেশ ও দেশের মানুষ, তার পরিবেশ, সমাজ সম্পর্কে সচেতনতারও প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং শিক্ষার মাধ্যমে তাদের দেহ-মনের সার্বিক বিকাশ সাধন করা, সমাজ ও দেশের প্রতি অনুরাগ এবং পরার্থপরতায় আত্মোৎসর্গের মানসিকতা গঠন করাই হল প্রকৃত শিক্ষা। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়—Education is alround development.

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রদের দায়িত্ব

আজ একবিংশ শতকে ভারতবর্ষের বিরাট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ নিরক্ষর। নিরক্ষরতা দেশ ও জাতির জীবনে অভিশাপ। দেশে নিরক্ষরের সংখ্যা বেশি থাকলে দেশের উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই তরুণ ছাত্রসমাজ চোখে জ্ঞানের মশাল জ্বেলে অদম্য উৎসাহ বুকে নিয়ে সাক্ষরতা অভিযানে অংশ নিয়ে ন্যূনতম শিক্ষা দানের মাধ্যমে অন্তত কিছু মানুষকে সাক্ষর করে তুলতে সক্ষম হলে, এতে তাদের শিক্ষা সার্থক হয়। তারা যদি অবসর সময়ে শিশু, নারী ও বয়স্ক মানুষদের পড়া, লেখা ও সাধারণ গণিতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে তবে তা তাদের কাছেও অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার হয়ে উঠবে।

ঐতিহ্য সচেতনতা

আমাদের দেশের বিশেষত গ্রাম বাংলার বহু মানুষ আজও অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকায় তারা নিজের দেশ সম্বন্ধে, নিজের সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ, অজ্ঞ। তারা নিজের দুঃখ-কষ্টকে জীবনের অঙ্গ বলে মনে করে। তাই নিজের ভাগ্যকে দোষী সাব্যস্ত করে। দেশের এইসব মানুষকে ন্যূনতম শিক্ষাদানের মাধ্যমে সচেতন করে তুলতে হবে। তারা একদিন নানাভাবে বিভিন্ন জনের কাছে প্রতারিত ও লাঞ্ছিত হয়েছে ও হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে তারা নিজের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এইসব মানুষকে দেশের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করে তাদের মধ্যে জাতীয়চেতনা সঞ্চার করতে পারে ছাত্রসমাজ। তারা প্রয়োজনে নাটক, অভিনয়, সংগীত, ঘরোয়া আলাপচারিতার দ্বারা গ্রামবাসীদের উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে পারে।

শিক্ষার ত্রুটি

ছাত্ররা দেশের সর্ববৃহৎ শক্তি। তা সত্ত্বেও অনেক সময় সঠিক নেতৃত্বের অভাবে তারা হয়ে পড়ে বিপথগামী, পথভ্রষ্ট, দিশাহারা, উচ্ছৃঙ্খল। কোন্‌টা গ্রহণীয়, কোন্‌টা বর্জনীয় তা স্থির করতে না পেরে তারা সমাজবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত হয়। নানাবিধ নেশায় আসক্ত হয়। অনেক সময় তারা সংকীর্ণ রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

শিক্ষা সংস্কারে ছাত্রসমাজ

ছাত্ররা দেশের ও জাতির কাণ্ডারী। তাই তারা যাতে ভ্রান্তির শিকার না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। শিক্ষার প্রধান কথা আত্মবিকাশ ও যুক্তিবাদ। যুক্তির আলোকে সব কিছুর বিচার বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদের। পারস্পরিক শ্রদ্ধার মনোভাব, গুরুজনদের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা, আন্তরিক মেলামেশার মধ্য দিয়ে তারা মানবতার মহিমাকে উপলব্ধি করবে এবং অপরকেও করাবে। তাদের কোনো বন্ধু যদি বিপথগামী হয়, নেশাগ্রস্ত হয়, তবে তাকে সহানুভূতি দিয়ে বোঝাতে হবে, সৎপথে ফেরাতে হবে। শুধুমাত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া নয়, সুকুমার প্রবৃত্তিগুলোর বিকাশসাধনেই শিক্ষা পূর্ণতা পায়।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ

আজ ভারতবর্ষের প্রধান সমস্যা সাম্প্রদায়িকতা ও
বিচ্ছিন্নতাবাদ। সারা দেশ জুড়ে চলছে হিংসাত্মক ঘটনা, ধর্মীয় সংঘাত। এই পরিস্থিতিতে ছাত্রদের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। তাদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে বোঝাতে হবে আমরা সকলেই মানুষ, সবার দেহেই একই রক্ত প্রবাহিত। আমরা একই ভারতমাতার সন্তান। তাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে এবং দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে। কোনো বহিঃশক্তি যাতে আমাদের দেশকে টুকরো টুকরো না করতে পারে সেদিকে ছাত্রসমাজ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, মানুষকে সতর্ক ও সচেতন করবে।

দুর্নীতিরোধে ছাত্রসমাজ

বর্তমানে মানুষের মন থেকে ন্যায়-নীতি-সততা ক্রমশই অবলুপ্ত হচ্ছে, সেখানে জন্ম নিচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরায়ণতা, দুর্নীতিপ্রবণতা ও নৈতিক অবক্ষয়। দেশের উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিরাই দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এই সময় ছাত্রদের এগিয়ে আসতে হবে দুর্নীতিদমনে। মানুষের মধ্যে ন্যায়, শক্তি ও সততার বাণী প্রচার করতে হবে। সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে তুলতে হবে জালিয়াতি, ভেজালদার, দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের সম্পর্কে। এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এক দুর্নীতিমুক্ত নতুন সমাজ গঠনে
তাদের আগ্রহী ভূমিকা নিতে হবে। সুস্থ সামাজিক পরিবেশ জন্ম দেয় একজন সুস্থ স্বাভাবিক
মানুষ তথা নাগরিকের।

সমাজসেবায় ছাত্রসমাজ

দুর্বার প্রাণশক্তিসম্পন্ন ছাত্রসমাজ অসহায়, দুর্গত মানুষের পরম বন্ধু, তাদের আশ্রয়। প্রাকৃতিক দুর্বিপাক যথা—বন্যা, খরা ভূমিকম্প জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। লক্ষ লক্ষ মানুষ হয়ে পড়ে গৃহহারা, পথের ভিক্ষুক। খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে তাদের জীবনসংশয় দেখা দেয়। সেই সময় দেশের তরুণ ছাত্ররা অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাধ্যমত সহায়তা দান করে। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর কাজেও তারা অংশগ্রহণ করে। নিজের জীবন বিপন্ন করেও তারা মানুষের সেবায়, আর্তের সেবায় আত্মনিয়োগ করে। এতে তাদের মনের প্রসার ঘটে।

পরিবেশ দূষণরোধে ছাত্রসমাজ

আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ পরিবেশ দূষণ রোধে এক বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা তাদের বাড়ির ভিতরে ও চারপাশে গাছ লাগাবে। প্রতিবেশীদের ‘গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান' বলে উৎসাহিত করবে। হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদির নিকটবর্তী অঞ্চলে জোরে মাইক বাজালে, শব্দবাজি পোড়ালে বা গাড়ির হর্ন বাজালে প্রতিকারের জন্য থানায় খবর দেবে। শহরাঞ্চলে আবর্জনা পরিষ্কার, জলনিকাশি ব্যবস্থা পরিদর্শন, পথের পাশে নর্দমায় মশা মাছি ধ্বংস করা, খোলা হাইড্রেন বন্ধ করা—ইত্যাদি অভিযানে ছাত্ররা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। গ্রামাঞ্চলেও পরিবেশকে সুস্থ রাখার কাজে ছাত্ররা সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে। অশিক্ষিত মানুষদের শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার জন্য তারা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।

উপসংহার

যুগে যুগে ছাত্ররাই সমাজ গঠনে ও পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। দেশের এই তরুণ প্রাণশক্তি যদি সবদিক থেকে শক্তিশালী ও আত্মনির্ভরশীল হয়, তবে দেশ উন্নতির শিখরে উঠতে পারে। ছাত্ররাই তো দেশ গড়ার কারিগর। তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে পারি—
“ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।”
এই প্রবন্ধের সাহায্যে যেসব রচনা লেখা যেতে পারে -
1. ছাত্র সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য
2. সমাজ উন্নয়নে ছাত্র সমাজের ভূমিকা
3. সচেতনতার বিকাশে ছাত্র সমাজের ভূমিকা
4. সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য রচনা
5. ছাত্র জীবনে বিজ্ঞাপনের প্রভাব
6. ছাত্র সমাজ কি?
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url