বাংলার উৎসব রচনা

বাংলার উৎসব রচনা

ছক বাঁধা জীবনে এই মন মাঝে মাঝে মুক্তি পেতে চায়,
উৎসবের আনন্দ সুধাপানে জীবনের দুঃখ ভুলে যায়

রঙ্গভরা বাংলা

বাংলা হল, উৎসবের দেশ। এখানে বারো মাসে তেরো পার্বন। কবি ঈশ্বরগুপ্ত রসিকতা করে বলেছেন,
‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা।’ এর কারণ, মেজাজে ও স্বভাবে বাঙালি জাতি হল স্ফূর্তিবাজ, সঙ্গপ্রিয় ও মিশুক। অভাব ও দারিদ্র্য থাকা সত্ত্বেও, তারা দুর্নিবার প্রাণশক্তির অধিকারী। বাংলার উৎসবগুলিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায় বাঙালির এই দুর্নিবার, অফুরন্ত প্রাণশক্তি। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমির মাঝে নূতনের বারতা নিয়ে আসে উৎসবের কলধ্বনি। বাংলার উৎসবগুলোর মধ্য দিয়ে বাঙালির ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায়।

নানারকম উৎসব

বাংলার উৎসবগুলিকে মূলত জাতীয়, ধর্মীয়, ঋতুসম্বন্ধীয় এবং সামাজিক প্রভৃতি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় উৎসব পরিণত হয় জাতীয় উৎসবে। আবার সামাজিক উৎসবের অনেকগুলিই এক অর্থে পরিণত হয় পারিবারিক উৎসবে। —এই ধরনের প্রচুর রকমফের আছে।

রাষ্ট্রীয় উৎসব : দেশ জুড়ে

২৬শে জানুয়ারির প্রজাতন্ত্র দিবস, ১৫ই আগস্টের স্বাধীনতা দিবস, রবীন্দ্র নাথের জন্মদিন ২৫শে বৈশাখ, ২রা অক্টোবর, ২৩শে জানুয়ারি ইত্যাদি দিনগুলি হল জাতীয় উৎসবের অন্তর্ভুক্ত। প্রজাতন্ত্র দিবসে ও স্বাধীনতা দিবসে সমগ্র জাতির চেতনায় এক নব উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে দেশব্যাপী সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীতের মাধ্যমে তাঁর অমর কীর্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। ২৩শে জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনে সমগ্র জাতি সভা, শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে।

ধর্মীয় উৎসব

বাংলা হল বিভিন্ন ধর্মের লীলাভূমি এবং বিভিন্ন ধর্মমতাবলম্বী মানুষের বাসস্থান। এখানকার ধর্মীয় উৎসব তাই বিচিত্র। হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল দুর্গোৎসব। দুর্গাপুজো শুধুমাত্র পুজো নয়, এটি এখন একটি জাঁকজমকপূর্ণ জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। দুর্গোৎসব ছাড়া হিন্দুদের ভেতর রথযাত্রা, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, সরস্বতীপুজো প্রভৃতি উৎসবগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনেকগুলি পুজোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা, প্রদর্শনী প্রভৃতিরও আয়োজন হয়। মুসলমানদের উৎসবগুলির মধ্যে মহরম, ঈদ, বকরিদ, সবেবরাত, সবে মেরাজ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টানদের সবথেকে বড়ো উৎসব হল বড়দিন। এছাড়া, বৌদ্ধগণ বুদ্ধপূর্ণিমা, জৈনগণ পরেশনাথের জন্মদিন এবং বৈষ্মবগণ চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি সাড়ম্বরে পালন করেন।

সামাজিক ও পারিবারিক উৎসব

সামাজিক ও পারিবারিক উৎসবগুলির মধ্যে জন্মদিন পালন, বিবাহ, নববর্ষ, উপনয়ন, অন্নপ্রশান, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, জামাইষষ্ঠী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই উৎসবগুলি মূলত পারিবারিক; কিন্তু বহু মানুষের উপস্থিতির ফলে ওইগুলি মিলনোৎসবে পরিণত হয়। পারিবারিক উৎসবগুলির মধ্যে ‘অম্বুবাচি’, ‘নবান্ন’, ‘পৌষসংক্রান্তি’ প্রভৃতি উৎসবগুলি মূলত কৃষিভিত্তিক। এগুলি ছাড়া মন্দির প্রতিষ্ঠা, বৃক্ষরোপণ, ভূমিদান ইত্যাদি উৎসবগুলি সামাজিক কল্যাণহেতু অনুষ্ঠিত হয়। নববর্ষ, বৃক্ষরোপণ, বর্ষামঙ্গল, হলকর্ষণ, শারদোৎসব, বসন্তোৎসব প্রভৃতি হল ঋতু উৎসবের অন্তর্গত।

লৌকিক উৎসব

বাংলার উৎসবানুষ্ঠানে বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য দুই-ই বিদ্যমান। নিতান্ত স্থানীয় পরিবেশে, লৌকিক প্রয়োজনে বা সমসাময়িক প্রভাবে বাংলার নিজস্ব উৎসবগুলির সৃষ্টি। চড়ক পূজা, গাজন উৎসব ইত্যাদি বাঙালির নিজস্ব। শীতলা, সত্যনারায়ণ প্রভৃতি পুজো আর্যসংস্কৃতি অনুমোদিত নয়। ঋতু উৎসবগুলি বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যের উপহার। মহাপুরুষদের জীবন মহিমাও বাঙালিকে উৎসবের আয়োজনে ব্রতী করেছে।

উৎসবের আনন্দ

আমার আনন্দে সকলের আনন্দ হোক, আমার শুভে সকলের শুভ হোক্, আমি যাহা পাই তাহা পাঁচজনের সহিত মিলিত হইয়া উপভোগ করি—এই কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ।” তাই উৎসবের দিনটি ধনী-নির্ধন, জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের মিলনের, প্রীতি-বিনিময়ের এবং ভাবের আদানপ্রদানের পবিত্র মুহূর্ত।

উপসংহার

পরিশেষে বলতে হয়— উৎসব হল আনন্দের উৎসধারা। সেই উৎসবের আতিশয্য তখনই প্রকাশ পায়, যখন মানুষের মধ্যে থাকে আর্থিক সাচ্ছল্য। শুধু তাই নয়, বর্তমানে উৎসবের বাইরের দিকটি বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, যেমন প্যান্ডেল, মাইক, আলোকসজ্জা ইত্যাদি। ভিতরের দিকে রয়েছে দীনতা, দাম্ভিকতা ও বিকৃতি রুচি। এগুলি বর্জন করে মহামিলনের উদ্দেশ্যে উৎসবকে সকলের মঙ্গল কামনায় রঞ্জিত করতে হবে। সবার সাথে মিলেমিশে, সবার রঙে রঙ রাঙিয়ে নিজেকে সুন্দর করে তুলতে পারলেই, তবেই উৎসবের সার্থকতা।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url